আমি তো মরেই যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবি/ আছসনি কেউ সঙ্গের সাথী, সঙ্গেনী কেউ যাবি / আমি মরে যাব…’- শতাব্দীর ভয়ঙ্কর খুনি খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের সেই বিখ্যাত গানের প্রথম দুই লাইন এটি। মানুষ খুন করেই যিনি দুধ দিয়ে গোসল করে পবিত্র হতেন। পবিত্র হওয়ার পর ‘জলসা’র আয়োজন করতেন। আর সেই জলসার মূল আকর্ষণ থাকত এরশাদ শিকদারের নিজ কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি। পরবর্তীতে কাকতালীয়ভাবে সেই গানটির প্রতিটি লাইনের সঙ্গেই তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রেফতারের পরপরই তার সহায়সম্পদ পরিবারের সদস্যরা যে যার মতো দখল করে নেয়।
২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ পর্বে এরশাদ শিকদার তার স্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘শত শত কোটি টাকার সম্পদ রেখে গেলাম। আমার নামে একটা গরু কোরবানি দিতে পারলা না? তাইলে তো আমি বাঁইচা যাইতাম। আমার এই দুঃসময়ে তোমরা কেউ পাশে রইলা না।’ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে রূপ নেয়া এরশাদ শিকদারের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কেটেছে দৈন্যদশায়। তার রেখে যাওয়া টাকা ও সম্পদ কেউ তার পেছনে খরচ করতে চাননি।
কারাগারের অভ্যন্তরে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের এ নিয়ে বকাঝকাও করতেন তিনি। এমনি পরিস্থিতিতে কনডেম সেলের ভিতরেও তার বিখ্যাত গানটি তিনি গাইতেন গুনগুন করে। এরশাদ শিকদারের নৃশংসতা এমনই ভয়াবহ ছিল যে, আস্তে-ধীরে রয়ে-সয়ে কষ্ট দিয়ে খুন করতেন তিনি। তার বরফকলে যার ডাক পড়ত, তিনি আর কখনোই সেখান থেকে জীবিত বের হতে পারতেন না। এদের অধিকাংশের লাশও আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
এরশাদের নৃশংসতা : দিনভর সেখানে মানুষের কোলাহল। সন্ধ্যা নামতেই নিস্তব্ধতা। স্বল্প আলোয় গায়ে কাঁটা দেয়া অদ্ভুত এক ভৌতিক পরিবেশ। শুধু একটি কক্ষ থেকে মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। কিন্তু খুলনার ঘাট এলাকার এই বিশাল বরফকলের চার দেয়ালের ভিতরই চাপা পড়ে গগনবিদারী সেই আর্তনাদ। হাত-পা বাঁধা হতভাগ্য এক যুবকের পা চেপে ধরে রেখেছেন এরশাদ শিকদার। আরেকজন বড় হাতুড়ি দিয়ে পায়ের ওপর পিটিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। পা থেঁতলে গেছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে দুই পায়ের হাড়। হাতুড়ি রেখে মানুষরূপী দানব এরশাদ শিকদার ধীরেসুস্থে একটি রশি নিলেন। রক্তাক্ত যুবকের গলায় পেঁচিয়ে ধরে টান দিলেন।
যুবকটির নড়াচড়া তখন বন্ধ। নাক-মুখ এমনকি চোখ দিয়েও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। জিভ একটু বেরিয়ে পড়েছে। মানুষরূপী দানবটি মৃত যুবকের নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্চিত হলেন, প্রাণ নেই। এরপরও তিনি ঠাণ্ডা হলেন না। হঠাৎ মেঝের ওপর পড়ে থাকা যুবকটির বুকের ওপর দাঁড়ালেন। লাফাতে শুরু করলেন। পাঁজর ভাঙার শব্দ হলো। শান্ত হলেন তিনি। এরপর বড় এক বালতি দুধ দিয়ে গোসল করলেন এরশাদ। যুবকের লাশ জমাটবাঁধা সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দেয়া হলো ভেরব নদে।
শতাব্দীর ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের খুনের নিজস্ব কৌশল এটি। ঠিক এভাবেই তিনি একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি কাঁপিয়েছেন। তার হাতের মুঠোয় ছিল জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যার পর খাঁটি দুধ দিয়ে গোসল করে ‘পবিত্র’ হতেন। যাকে পথের কাঁটা মনে করেছেন, তাকেই তিনি হত্যা করেছেন।
তার সহযোগী ও পরবর্তীতে মামলার রাজসাক্ষী নূরে আলমের মতে, এরশাদ শিকদার কমপক্ষে ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তবে তিনি ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। ১১ বছর আগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা হলেও মানুষের কাছে তিনি এখনো নৃশংসতার প্রতীক। কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদার তার রাজত্বকালে রূপসার যুবলীগ কর্মী খালিদ; দৌলতপুরের অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর ফটিক; সোনাডাঙ্গার ইনসাফ, কামাল, খালেক; সেনহাটির টাক আজিজসহ আরও অনেককে হত্যা করে জমাট সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে ভৈরব নদে ফেলে দেন।
এর মধ্যে শুধু খালিদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদের লাশ পাওয়া যায়নি। তবে তাদের পরিধেয় কাপড় আর কিছু হাড় পরবর্তীতে পুলিশ উদ্ধার করে। খুলনার এই ডন নিয়ন্ত্রণ করতেন আন্ডারওয়ার্ল্ড। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হন এরশাদ শিকদার। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে তার নৃশংসতার অজানা সব কাহিনী। তার নৃশংসতার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতবাক। খুলনার কারাগারে নেওয়ার পর সেখানেও পেশাদার অপরাধীরা তার বিচার চেয়ে মিছিল করেন। শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মায়েরা এখনো এরশাদ শিকদারের নাম বলে ভয় দেখান।
এখনো কোথাও কোনো নৃশংস ঘটনা ঘটলেই চলে আসে এরশাদ শিকদারের নাম। বিদেশি গণমাধ্যমেও সিরিয়াল কিলার হিসেবে এরশাদ শিকদারের নাম উঠে আসে। তখন খবর বেরিয়েছিল, তার মুক্তির ব্যাপারে শত কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়। তার ছোট স্ত্রী শোভা এ সময় কয়েক বস্তা টাকা নিয়ে ঢাকায়ও এসেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদ শিকদারের বিষয়ে সিদ্ধান্তে অটল থাকায় সে সময় আর রক্ষা পাননি তিনি। এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন।
খুলনায় আসার পর এরশাদ সেখানে কিছু দিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন দলের সঙ্গে যোগ দেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পান। ১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি ‘রামদাবাহিনী’ নামে একটি দল গঠন করেন, যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। এ রামদাবাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্দপ্রকাশ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমান ২১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ আবারও দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছু দিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময়ও তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি ৪ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে রফিক নামে একজন বরফকলের মালিককে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করে বরফকল দখল করেন। সব ব্যবসায়ীকে তার কল থেকে বরফ কিনতে বাধ্য করেন। নূরে আলম আরও সাক্ষ্য দেন, এরশাদের কাছে ৭০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। যদিও তার ‘স্বর্ণকমল’ নামে খ্যাত বাড়ি থেকে মাত্র একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
যেভাবে খুন : ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট হত্যা করা হয় যুবলীগের খালিদকে। সে সময় খালিদের সঙ্গে ছিলেন খুলনার ব্যবসায়ী আপন দুই ভাই মুনির ও চয়ন। এ দুজনের ওপরও এরশাদ শিকদার নির্মম নির্যাতন চালান। নির্যাতনের শিকার চয়ন আদালতে জানান, ‘সন্ধ্যার পর জরুরি কথা আছে বলে এরশাদ শিকদার আমাদের ৫ নম্বর ঘাটে ডেকে নিয়ে আসেন। আমরা একটি প্রাইভেট কারে আসি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মুনির, যুবলীগ কর্মী খালিদ, মোস্তফা ও ড্রাইভার আবুল। আমাদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে এসেছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসিত বরণ।
ঘাটে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ শিকদার তার লোকদের নিয়ে ওজন মাপার হন্দর, শাবল, হাতুড়ি দিয়ে হামলা চালান। আমার বড় ভাই মুনিরের দুই পা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। খালিদকে ধরে বরফকলে নিয়ে যান। সেখানে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর এরশাদ নিজেই খালিদের পাঁজর ভেঙে লাশের সঙ্গে জমাট সিমেন্টের বস্তা বেঁধে ভৈরব নদে ফেলে দেন। লাশের সঙ্গে আরও ফেলে দেয়া হয় আমাদের প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, এরশাদ শিকদার ১৯৯৯ সালের প্রথম দিকে খুলনা নিউমার্কেট এলাকায় নৈশপ্রহরী ইনসাফ, কামাল ও খালেককে ৫ নম্বর ঘাটে ধরে নিয়ে একইভাবে হত্যা করে ভৈরবে ফেলে দেন।
এরশাদের একসময়ের সহযোগী টাক আজিজকেও হত্যা করে ভৈরবে ফেলে দেয়া হয়েছে। দৌলতপুরের পাবলার অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর ফটিককেও এরশাদ নিজ হাতে হত্যা করেন। পরে তার লাশ নদে ফেলে দেন। ফটিকের লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি। এরশাদের দেহরক্ষী নূরে আলমের স্বীকারোক্তিতে ফটিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায়। এ ছাড়া ঘটনার পরপর ফটিকের বাবা হাশেম আলীও তার মেধাবী সন্তান হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন।
নূরে আলমের ভাষ্য হচ্ছে, ‘এরশাদের বড় বউ খোদেজার সঙ্গে ফটিকের প্রেম রয়েছে- এ অভিযোগেই তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল এরশাদ খোদেজার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে দিয়েই ফটিককে স্বর্ণকমলে ডেকে নিয়ে আসেন। সন্ধ্যায় ৫ নম্বর ঘাটের বরফকলে নিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে ফটিককে হত্যা করা হয়। এরপর এরশাদ ফটিকের বুকে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে তার পাঁজর ভেঙে দেন। পরে জমাট সিমেন্টের সঙ্গে ফটিকের লাশ বেঁধে ভৈরব নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়।’ বিভিন্ন মাধ্যমে এরশাদের ছয়টি বিয়ের কথা জানা যায়। তার প্রথম স্ত্রীর নাম খোদেজা বেগম।
সানজিদা আক্তার শোভা তার সবচেয়ে ছোট স্ত্রী। যাকে তিনি তার বিলাসবহুল বাড়ি স্বর্ণকমলে এনেছিলেন। এ ছাড়াও রূপসার রাজাপুর গ্রামের তসলিমা, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফরিদা, সহযোগী বারেক কমান্ডারের স্ত্রী রামেছা এবং যাত্রাদলের নায়িকা পাইকগাছার দুর্গারানীর কথা জানা গেছে। খোদেজার গর্ভে এরশাদের চারটি সন্তান রয়েছে। শোভার গর্ভে এষা নামে একটি মেয়ে আছে।
রাজধানী ঢাকায় তার তিনতলা বাড়ি রয়েছে। যেখানে প্রতি মাসে তিনি জলসার আয়োজন করতেন। সেখানে যোগ দিতেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী মানুষ। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হন এরশাদ শিকদার। তখন তার নামে ৪৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর অধিকাংশই হত্যা মামলা। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয় ও চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করে দেন এবং ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে টুটপাড়া কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন