Breaking

বুধবার, ৩ জুন, ২০১৫

নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনে নন্দকুমারের ভূমিকা

আমি কোন ইতিহাসবিদ নই । তারপরেও আমি ইতিহাস জানার জন্য আমি নিয়মিত দেশি বিদেশী বিভিন্ন লেখকের বই পড়ি । আমি যে বইটি পড়ে সবচেয়ে বেশি শিহরিত হয়েছি তা হলো চন্ডীচরণ সেনের লেখা ” মহারাজা নন্দকুমার অথবা শতবর্ষ পূর্বে বঙ্গের সামাজিক অবস্হা ” । এই বইটির প্রকাশ কাল ১২৯২ সালে ১০ পৌষ, ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দ ২৫ ডিসেম্ভর কোলকাতার ভিক্টোরিয়া প্রেস হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত । সাইজ ডিমাই । পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৫ + ৩৯২, মূল্য উল্লেখ নেই । এই  বইটি এখনও সংরক্ষিত আছে প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভান্ডার কোলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে । বিশাল এই লাইব্রেরিটি বেলভেডিয়ার নামে বিখ্যাত । বেলভেডিয়ার নামক এই বিশাল ভবনটির প্রতিষ্ঠাতা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন্ট হিষ্টিংস । তিনি ছিলেন প্রচন্ড ঘোষ খোর । আর এই ঘুষের টাকা দিয়েই ৭০ বিঘা জমির উপর বাগানবাড়ী তৈরী করেন আর এই বাগানবাড়ীতেই ন্যাশনাল লাইব্রেরির অবস্হান । আর এই কারনেই ওয়ারেন্ট হিষ্টিংসকে আধুনিক সভ্য ভারতের শিক্ষা ব্যবস্হার গুরু ঠাকুর  বলা হয় ।
আমরা সবাই জন্মগ্রহনের পরপরই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যাল পর্যন্তও মীরজাফরের কুকীর্তি সহ  নানা কাহিনী বিভিন্ন পাঠ্য পুস্তকে পড়ে এসেছি । এই নামটি এতটাই ঘৃনিত যে মানুষ তার মুখেও আনতে চায়  না । কিন্তু চন্ডীচরণ সেনের লেখা ” মহারাজা নন্দকুমার অথবা শতবর্ষ পূর্বে বঙ্গের সামাজিক অবস্হা ” এই বইটি পড়ে স্পষ্টতই ধারনা পাওয়া যায় যে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান সম্রাটদের সাম্রাজ্য পতনের পিছনে মীরজাফরের যতটা ভূমিকা ছিল তারচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল মহারাজা নন্দকুমার ও তৎকালীন সময়ের দেশীয় হিন্দুরাজাদের কূটনীতি । তখনকার সময়ে হিন্দুরা মনে করত মুসলমানদের অধীনে চাকুরী করার ফলে তাদের পাপ হচ্ছে এবং তাদের জাত কূল মাণ সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে । এক কথায় মুসলমানদের প্রতি তাদের ছিল প্রচন্ড ঘৃনা ও বিদ্বেষ । যা আজও আছে । দূর থেকেও যদি কোন উচ্চ বংশীয় হিন্দু মুসলমাদের দেখত তাহলে তারা নম নম করে পুকুরে অথবা নদীতে নেমে যেত এবং শরীর ও কাপড় পানি দিয়ে পরিস্কার করে তারা বাড়ী ফিরে যেত । চন্ডীচরণ সেনের এই বইটই পড়ে এটাও বুঝা যাচ্ছে যে কোন হিন্দু কোন মুসলমানের দোকান থেকে কোন দ্রব্য অথবা পরিধেয় বস্ত্র কিছুই ক্রয় করত না । মুসলিম সাম্রাজ্য পতনের পিছনে তৎকালীন মুসলিম সম্রাটদের লোভ লালসা ও চরিত্রহীনতাও কিছুটা দায়ী । মুসলমান সম্র্রাটদের রাজদরবারের উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল বেশি । এর ফলে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য পতনের পিছনে ইংরেজদের সাথে দেশীয় হিন্দু রাজারা একসাথে ষড়যন্ত্র  করেছে ও সফলও হয়েছে । কিন্তু তারা এমনভাবে ষড়যন্ত্র করেছে যে সব দোষ মীরজাফররের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে । এখন আমার কাছে মনে হয় মীরজাফরের পাশাপাশি ঐসব হিন্দুদের নামও ঘৃনাভরে স্মরন  করা উচিত । পাঠকদের আমি কয়েকটি পর্বে নবাব সিরাজ  - উদ – দৌলা পতনের পিছনের মূল কারিগর  মহারাজা নন্দকুমার ও দেশীয় হিন্দু রাজাদের গভীর ষড়যন্ত্রের একটি অংশ তুলে ধরতে চাই ।
চন্ডীচরণ সেন সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলা অবশ্যই প্রয়োজন । চন্ডীচরণ সেন ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দের জানুুয়ারী মাসে বরিশাল জেলার বাসন্তী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন । পিতা নিমচাঁদ ও মাতা গৌরী দেবী । চন্ডীচরণ সেন ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে বরিশাল সরকারী হাই স্কুল থেকে এনট্রান্স পাশ করেন । পরে ফ্রী চার্চ ইনষ্টিটিউশনে কিছুদিন অধ্যয়ন  করেন  । অতঃপর ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে আইন পরীক্ষায় পাস করে বরিশাল আদালতে আইন ব্যবসা শুুরু করেন । কয়েক বছর পর সরকারী চাকুরীতে যোগ দেন । প্রথমে  মুন্সেফ ও পরে সাব জজ পদে নিয়োজিত হন । মহারাজা নন্দকুমারকে কেন্দ্র  করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পাানি তাদের কারয বিবরনী PROCEEDINGS OF THE GOVERNOR AND CALCUTTA COUNCIL গ্রন্হে যেগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল সেগুলো ফোরট উইলিয়ামের রেকর্ড রুমের কর্তা ব্যক্তিদের সহযোগীতায় চন্ডীচরণ সেন সংগ্রহ করেন এবং  ” মহারাজা নন্দকুমার অথবা শতবর্ষ পূর্বে বঙ্গের সামাজিক অবস্হা ” নামক গ্রন্হটি প্রনয়ন করে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশ করেন । গ্রন্হটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেবী প্রসাধ চৌধুরী সম্পাদিত নব্য ভারতীয় পত্রিকায় ১২৯৩ সালের কার্ত্তিক সংখ্যায় সমালোচনা প্রকাশিত হয় এবং এই প্রচারণায় সরকার অবগত হয়ে চন্ডীচরণ সেনকে চাকুরীচ্যুত করেন এবং সেই সাথে কারাদন্ডে দন্ডিত করেন । কারামুক্ত হয়ে লেখক ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে ” গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ” নামক গ্রন্হ প্রকাশ করেন । ঐ বছরই লেখেন ” অযোদ্ধার বেগম ” । লেখকের মোট গ্রন্হের সংখ্যা মোট ৯ টি । চন্ডীচরণ সেন শেষ জীবনে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন এবং তার কন্যা কামিনী রায় তৎকালে মহিলা কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন ।
যে ব্যক্তি দেশদ্রোহী ও নিজের জন্মভূমিকে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে এতটুকু কার্পণ্য বোধ করেনি সেই নন্দকুমারের পরিচয়টাও পাঠকদের জানানো দরকার । নন্দকুমার শুধু নবাব সিরাজ – উদ – দৌলার পতনই করেনি সেই সাথে বাংলার আকাশে ইংরেজদের দুইশত বছরের শাসনামলের সূর্যও উদিত হতে সাহায্য করেছিল । এর জন্য মহারাজা নন্দকুমার ও দেশীয় হিন্দুরাজারাই অধিকাংশ দায়ী ।
নন্দকুমার রায়, জন্মগ্রহন করেন পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে । পিতার নাম পদ্মনাভ রায় । পদ্মনাভ রায় মাতৃভাষা বাদে দেব ভাষা, সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত ছিলেন এবং ফার্সি ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন । এই ফার্সি ভাষার গুনেই পদ্মনাভ রায় সুবেদার আজিমুশানের শেষ অধ্যায়ে জরিপ বিভাগে কাজ নেন ।  মুর্শিদকুলি খাঁ সুবেদার নিযুক্ত ( ১৭১২ – ২৫ ) হওয়ার কিছুদিন পর রাজধানী স্হানান্তর করেন মকসুদপুরে । রাজধানী মকসুদপুরে স্হানান্তরিত করেই নিজ নাম অনুসারে নাম করেন মুর্শিদাবাদ । আর এই কাজে পদ্মনাভ রায় যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন । এতে মুর্শিদকুলি খাঁ খুশি হয়ে পদ্মনাভ রায়কে প্রধান আমিন পদে উন্নীত করেন । এরপর নবাব সুজা – উদ – দৌলা ( ১৭২৫ – ৩৯ ) । নবাব সরফরাজ খাঁ ১৭৩৯ – ৪০ ।  আলীবরদি খাঁ গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব সরফরাজ খাঁকে পরাজিত ও হত্যা করে মুর্শিদবাদের মসনদে বসেন । এতগুলো বছরে কত নবাব এল আর গেল পদ্মনাভ রায়ের কিছুই হয়নি ।
পদ্মনাভ রায় উচ্চবংশ অনুসারে তার পুত্রকেও তার মত সকল ভাষায় পন্ডিত করে তুলেছিলেন । একদিন নবাব আলীবরদি খাঁর দরবারে পদ্মনাভ রায় তার পুত্র নন্দকুমারকে নিয়ে উপস্হিত হয়ে চাকুরী প্রার্থনা করলে নবাব তা মন্জুর করেন এবং জরিপ বিভাগে তিনি কাজ শুরু করেন । এরপর তাকে হুগলির ফৌজদার মীরজাফরের অধীন রাজস্ব বিভাগে দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন । এর কয়েক বছর পর নন্দকুমার ৮০ হাজার টাকা চুরি করলে তাকে চাকুরীচ্যুত ও কারারুদ্ধ করা হয় । এই ঘটনা অবগত হয়ে বাবা পদ্মনাভ রায় ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন ও নবাব আলীবরদি খাঁর কাছে ক্ষমা চান । নবাব ক্ষমাও করে দেন । এই সময় ফৌজদার মীরজাফর মারাঠাদের বিতাড়িত করে হুগলি থেকে বরধমানে চলে যান । এর ফলে হুগলির ফৌজদার পদটি খালি হয় এবং সেই শূন্য স্হানে নবাব চোর নন্দকুমারকে নিয়োগ দেন । এই পদে হুগলিতে অবস্হানকালীন সময়েই নবাব সিরাজ – উদ – দৌলার পতনের জন্য প্রথম ১২ বার হাজার টাকা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে গ্রহন করেন । ভাগ্যের কি পরিহাস এই নন্দকুমারকেই পরে ইংরেজরা সামান্য চুরি অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল ।
বৃটিশ সাংবাদিক লিওনার্দো মোজলে রচিত ” The Last Days of British Raj ” গ্রন্হটি  পাক – ভারত – বাংলাদেশ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লখযোগ্য সংযোজন । এই বইটি এতই সমাদৃত যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় স্হান করে নিয়েছে । লেখক জীবনের অনেকটা সময় ভারতে কাটিয়েছেন এবং সাংবাদিকতা সূত্রে উপমহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন । এই বইটির প্রারম্ভেই  উপমহাদেশের জনগন নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন । মন্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন – ” এই রকম রাজনৈতিক আবেগ প্রবন জাতি তিনি পৃথিবীর কোথাও দেখেননি । সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই কানকথা শুনেই যে কোন কথাকে বিশ্বাস করে আন্দোলনে অংশগ্রহন করা পৃথিবীর একমাত্র জাতি হলো উপমহাদেশের জনগন ।” এই সাংবাদিকের মন্তব্য আসলেই সঠিক । ইংরেজ ও দেশীয় হিন্দু রাজারা চক্রান্ত করে নবাব সিরাজ – উদ – দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার আকাশে যে দুশো বছরের ব্রিটিশদের শাসনামল প্রতিষ্ঠিত হলো তার জন্য কি শুধু মীরজাফর দায়ী ছিল ? একজন মাত্র ব্যক্তি কি একটি সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিতে পারে ? আমরা একবিংশ শতাব্দিতে বাস করেও সত্য ইতিহাস জানতে পারলাম না । নন্দকুমারের নেতৃত্বে একদল দেশীয় হিন্দুরাজা ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন এমনভাবে মিথ্যা কল্প কাহিনী ছড়াল যে সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল মীরজাফরের উপর আর মীরজাফর জাতীয় বেঈমান হিসেবে সবার কাছে ধরা পড়লেন ।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মুসলিম সম্রাটদের ফ্যাসাদ ছিল কিন্তু বানিজ্য শুল্ক নিয়ে । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সব রকমের বানিজ্য শুল্ক মওকুফ করে দিয়েছিলেন কিন্তু সম্রাট শাজাহান । এই বানিজ্য শুল্ক রহিত এই ধারার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু তৎকালীন রাজধানী দক্ষিন ভারতের বোরহানপুরে সম্রাট শাজাহানের দরবারে । আর এই বোরহানপুরই হলো মুসলমান সাম্রাজ্য পতনের উৎসস্হল । অনেক ঘটনার পর ১৬১৬ খৃষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের এক ফরমান বলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাট বন্দরে গোলা বারুদের কারখানা স্হাপন করে । এর বার বছর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় এবং শাজাহান পিতৃ সিংহাসনে আসীন হন । এর পাঁচ বছর পর সম্রাট শাজাহান সপরিববারে রাজধধানী বোরহানপুরে আগমন করেন । বোরহানপুর ছিল প্রাকৃৃতিকভাবেই খুব সুন্দর । আর এখানেই অন্কুরিত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্হাপনের ইতিহাস – সেটি ছিল ১৬৩৩ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের এক সন্ধ্যায় । আকাশে চাঁদ ছিল কিন্তু গরম ছিল অনেক । হাঁপিয়ে উঠেছিল শাহাজাদি জাহানারা । মনের উদভ্রান্ততা দূর করার জন্য জাহানারা হেরেমের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করে বাবুর্চিখানায় । বাবুর্চিদের কাজ বন্ধ হয়ে যায় । জাহানারা বাবুর্চিদের হাত থেকে লাকড়ী কেড়ে নেয়ে মুরগীর গোস্ত ভুনতে শুরু করেন । বাবুর্চিরা চলে যায় , মশালের আলো জ্বলছে । সবার দৃষ্টি জাহানার দিকে, চুলার আগুন যে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছিল সে দিকে কারও খেয়াল নেই । বৈরী আগুন শাহাজাদীর কাপড়ে লেগে যায় । সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং শাহাজাদী আতন্কে নিজ কামরায় প্রবেশ করে । এই দৃশ্য দেখে জাহানারার ধাত্রী সৌতি বেগম দৌড়িয়ে গিয়ে সুরাহির পানির ঝাপটায় আগুন নিভিয়ে ফেলে দ্রুত দরা বন্ধকরে দেন । দগ্ধ বস্ত্র অপসারন করে শরীর আচ্ছাদন করে দেন ।
এই ঘটনা দ্রুত শাহী মহলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংবাদ পেয়ে পিতা শাজাহান যথাস্হানে উপস্হিত হয়ে মা হারা কন্যার অবস্হা প্রত্যক্ষ করে বিচলিত হয়ে পড়েন । খবর পেয়ে শাহী হেকিম যে দাওয়াই দেন তা কয়েকদিন ব্যবহার করেও ফল না পেয়ে শাহাজাদীর দুঃসহ যন্ত্রনায় পিতা শাজাহান আরও বিচলিত হয়ে পড়েন । এমতাবস্হায় উজীর আসাদ খাঁ বিনয়ী কন্ঠে বাদশাহকে অনুরোধ করেন সুরাট বন্দর থেে বিদেশী হেকিম আনার জন্য । বিদেশী হেকিম আনার জন্য বাদশাহ হুকুম জারি করলেন এবং দূত পাঠালেন সুাট বন্দরে বিদেশী হেকিম নিয়ে আসার জন্য । এ সময় হোপওয়েল বানিজ্য জাহাজ সুরাট বন্দরেই ছিল । ১৬৩৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জাহাজে ছিলেন ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটন । এই গেব্রিয়েল বাউটনই জাহানারার চিকিৎসা করতে থাকেন । রোগ মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত শাহী মেহমান খানায় ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটনকে থাকার জন্য সম্রাট শাজাহান নির্দেশ দেন । তিন সপ্তাহ চিকিৎসা করার পর  জাহানারা সুস্হ হয়ে উঠেন । মা হারা কন্যা সুস্হ হয়ে উঠায় পিতা শাজাহান আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন এবং বিদেশী ডাক্তারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে হেকিমকে ইনাম দেবার জন্য সকাল দশটায় ডাক্তার গেব্রিয়েল বাউটনকে দরবারে আসার আহবান জানান ।
গেব্রিয়েল বাউটন দোভাষীর সাহায্য নিয়ে সম্রাট শাজাহানের কাছে পুরস্কার নয় এক বিশেষ ধরনের আব্দার করলেন । যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । তার  আব্দারে সভাষদ ও শাজাহান চমকে উঠেছিলেন । ডাক্তার নিজের জন্য না চেয়ে ইংরেজ জাতি যাতে বিনা মাাশুলে বাংলায় ব্যবসা করতে পারে তার জন্য লিখিত অনুমতি চাইলেন আর সামান্য এক খন্ড ভূমিও চাইলেন যাতে একটি কুঠি বানিয়ে ইংরেজ জাতি কোম্পানি গঠন করে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে । অঙ্গীকারাবদ্ধ সম্রাট শাজাহান ১৬৩৪ খৃষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারীতে বাংলায় বিনা মাশুলে ব্যবসা করার অনুমতি দেন কিন্তু কুঠি বানানোর জন্য ভূমি দেননি । ফরমানে উল্লেখ ছিল বাংলার পাশে পিপুলাই বন্দরে কুঠি বানানো যাবে তবে সুবে বাংলার সুবেদারের ইজাজাৎ মোতাবেক । এ সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন আজিম খাঁ । আজিম খাঁ সম্রাট শাজাহানের বিয়াই ছিলেন ।
ডাঃ বাউটন কুঠি  তৈরীর বিষয় নিয়ে ঢাকায় আগমন করেন সুবেদার আজিম খাঁর দরবারে । কিন্তু আজিম খাঁ জলদস্যু দমনে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি বাউটনকে সময় দিতে পারছিলেন না। বাউটনকে মেহমান খানায় অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল কিন্তু ডাঃ বাউটনের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না ।  ফিরে গিয়েছিলেন সুরাটে তার কর্মস্হলে । ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন শাহজাদা সাসুজা । সাসুজা সুুবেদার নিযুক্ত হয়েই ঢাকায় আগমন করে কয়েকদিন অবস্হান করে বুড়িগঙ্গা নদীর জোয়ার ভাটা দেখেন । কিন্তু এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও অধিবাসীদের আচার আচরণে সন্দেহ হওয়ায় তিনি রাজমহলে রাজধানী স্হানান্তর করেন । ১৬৪০ খৃষ্টাব্দে ভাগীরথি গঙ্গা বেয়ে বাউটন ভাগলপুর জেলার রাজমহলে উপস্হিত হন । এই সময়ে প্রধান বেগম পিয়ারা বানু অসুস্হ হয়ে পড়ে এবং বাউটনের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন । এর ফলে সাসুজা দারুন আনন্দিত হন । আর এই সুযোগেই ডাঃ বাউটন তার সুপ্ত মনোবাসনা পূরণ করতে সক্ষম হন । সাসুজা বাউটনকে পিপুলাই বন্দরে কুঠি তৈরীর অনুমতি দিয়েই থেমে থাকেননি । বাউটনকে হুগলির চন্দন নগরের দক্ষিনে ভাগীরথি গঙ্গার তীরে ভদ্রেশ্বর লাগোয়া আর একটি কুঠি তৈরী সহ বারুদের কারখানা স্হাপনের অনুমতি দিয়ে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রণ শক্তির সূচনা হয় এখান থেকেই ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন