পাঞ্জাবের মতো বিচিত্র অঞ্চল খুব একটা নেই। সেই সিন্ধু সভ্যতার ধ্যান-ধারণা দিয়ে ইতিহাসের শুরু। তারপর বৈদিক চিন্তা, আলেকজান্ডার পরবর্তী গ্রীক বিশ্বাস, বৌদ্ধ মতবাদের জয়রথ, আরব-মোগল-আফগানদের সাথে ইসলাম এবং ইউরোপীয় মিশনারির সাথে খ্রিষ্টধর্ম- সচেতন কিংবা অবচেতনেই থিতু হয়েছে এখানে। পাশাপাশি হাত ধরে বেড়ে উঠেছে সুফিবাদ এবং ভক্তিবাদ। ষোড়শ শতকের দিকে ইউরোপে যখন মার্টিন লুথার ক্যাথোলিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে মগ্ন। সে সময় পৃথিবীর অন্য প্রান্ত পাঞ্জাবের মাটিতে গুরু নানক প্রচার করছেন আরো বিশ্বজনীন জীবনদর্শন। উত্থান ঘটছে নয়া অনুসারীর- যারা শিখ নামে পরিচিত হয় অদূর ভবিষ্যতে।
|
পৃথিবীর কনিষ্ঠ ধর্মগুলোর মধ্যে একটা শিখ। চিত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির; image Source: velivada.com |
শিখ নামে প্রচলিত হলেও সঠিক উচ্চারণ ‘সিখ’। ইংরেজিতে seek শব্দের কাছাকাছি; কেবল k এর স্থানে kh উচ্চারণের ন্যায়। পাঞ্জাবি ‘সিখনা’ শব্দের অর্থ শিক্ষা এবং সিখ অর্থ শিক্ষার্থী বা শিষ্য। যিনি শিক্ষা দেন তাকে বলা হয় গুরু। অবশ্য অনুসারীরা বাংলায় শিখ হিসাবেই পরিচিত। যে ব্যক্তি এক অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে, নানক থেকে গোবিন্দ সিং অব্দি দশ গুরুতে বিশ্বাস করে, গ্রন্থসাহিব, শিক্ষাকীর্তন এবং অন্য ধর্মমতের প্রতি সহনশীলতায় বিশ্বাস করে; তিনিই শিখ হিসাবে পরিগণিত।
প্রেক্ষাপট
শিখ ধর্মদর্শনের স্পষ্টতার জন্য হাঁটতে হবে পেছনে। নবম শতকের দিকে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু ধর্মের বিপ্লব শুরু হয়। প্রথম সারিতে ছিল আলভার এবং আদ্যার নামে দুটি দল। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় আবেগময়তার অনুপস্থিতিকে কটাক্ষ করেন তারা। আলভাররা ছিল বিষ্ণুর ভক্ত আর আদ্যাররা শিবের। তবে দিনশেষে উভয়েই এক স্রষ্টারই উপাসনা করতো। তারা বর্ণপ্রথার কঠোরতা শিথিল করে ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার বাণী। একেশ্বরবাদ, মানবতার সাম্য এবং দলগতভাবে স্তুতিগান তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে দ্রুত। ফলে সাধারণ মানুষ ধর্মের নীরস তাত্ত্বিকতা ছেড়ে ঝুঁকে পড়তে থাকে তাদের দিকে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই আরবের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ভারতের। বণিকদের অনেকেই আর আরবে ফিরে যায়নি। ইসলাম আগমনের পরে সেই বৈশিষ্ট্য আরো পোক্ত হয়। ৬৩৬ সালের পর থেকে আরব মুসলমানরা মালাবার উপকূলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এখানেই বিয়ে করে স্থায়ী হতে থাকে। এভাবে স্থানীয়দের মধ্যে ধর্মের বিস্তার হওয়াতে দ্রুত নতুন ইন্দো-আরবীয় সমাজের তৈরি হলো। মুসলিমদের এ এক অন্য রূপ। ঘোড়ায় চড়ে সামরিক পোশাকে না; বণিক ও সুফির পোশাকে সমাজের নিচুতলায় চললো প্রচারণা।
|
দার্শনিক তত্ত্ব ছেড়ে তারা হাজির করেছিল ঈশ্বরপ্রেম আর মানুষের জয়গান; Image Source: apnaorg.com |
এই সময়েই প্রসারিত হয় হিন্দুধর্মে ভক্তিবাদ আর ইসলামে সুফিবাদ। ভক্তিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। উত্তর ভারতের রামানন্দ থেকে বাংলার চৈতন্য অব্দি। কবির যেন এগিয়ে যান কয়েক ধাপ সামনে। ঈশ্বরকে পাবার পথ হিসাবে তিনি ভালোবাসা আর ইচ্ছা সমর্পনের যে ব্যাখ্যা দেন; তাতে মিলিত হয়েছে ইসলাম আর হিন্দুধর্মের বিশ্বাস। অন্যদিকে মুসলিম সুফিরা ‘তোমরা যেদিকেই ঘুরবে, সেদিকেই পাবে আল্লাহকে’ বাণীতে নিজেদের নিবিষ্ট করে দিলেন। সুফিদের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তাদের জীবনপদ্ধতি এবং শ্রেণিহীনতার প্রচার। পাঞ্জাবের আলি মখদুম হুজুরি দানশীলতার কারণে গঞ্জ বকশ বা খোদার কোষাগার বলে খ্যাত হন। শেখ ফরিদ খ্যাত হন গঞ্জশোকর নামে। খোদাপ্রাপ্তির পথে ভক্ত আর সুফি উভয়েই হাঁটছে যেন একই পথে।
জন্ম
১৩৯৮ সালে তৈমুর লঙ-এর আক্রমণ ভারতের সংগঠিত সরকার ব্যবস্থায় একরকম সমাপ্তি আনে। রাজ্যপালরা দিল্লীর বিরোধিতা করে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকে। বিক্ষিপ্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক শাসনের প্রভাব পড়লো জনতার উপর। রাজকোষের স্বার্থে ভারী হয়ে আসতে থাকলো করের বোঝা। যতোই চাপ বাড়তে থাকলো, ধর্মান্তরিত মানুষেরা ফিরতে থাকে স্বধর্মে। লোদি বংশের যে বিশৃঙ্খলা বাবরকে ভারতে আসতে প্রলুব্ধ করেছিল; একই সময়ে জন্মানো ঘৃণা আর জবরদস্তির আবহে চাপা পড়ে যাচ্ছিল সুফি ও ভক্তদের ভালোবাসার গান।
১৪৬৯ সালের ১৫ এপ্রিল রাই ভো দি তালওয়ান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নানক। পিতা মেহতা কালিয়া এবং মা তৃপ্ত। সাত বছর বয়সে বর্ণমালা ও সংখ্যা শেখানোর জন্য পণ্ডিতের কাছে পাঠানো হয়। পরে আরবি ও ফারসি শেখার জন্য এক মুসলিম আলেমের সান্নিধ্যে থাকেন দুই বছর। কিন্তু পার্থিবতায় তার আগ্রহ ছিল না কখনোই। তাই পূন্যবান ব্যক্তিদের সাথে কিংবা নির্জনে ধ্যানমগ্ন সময় কাটাতে লাগলেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার শেষে একদিন নদীতে পূন্যস্নান করতে গেলে শুনতে পান দৈববাণী। আমূল বদলে দেয় তাকে ঘটনাটা। ছুটাছুটি করেন শ্রীলঙ্কা থেকে লাদাখ এবং মথুরা থেকে মক্কা। ১৫৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে ইহধাম ত্যাগ করেন।
|
গুরু নানক মক্কা, মদিনা এবং বাগদাদ ভ্রমণের সময় তাজউদ্দিন ও অন্যান্য শিষ্যের সাথে; Image Source: sikhnet.com |
নানকের প্রচারণা ছিল সহজ। ঈশ্বর তার কাছে কেবল আধ্যাত্মিক ধারণা হয়ে থাকেনি; এসেছে সামাজিক আচরণের নীতিমালা হিসাবেও। ঈশ্বর চূড়ান্ত সত্য হবার কারণে যা কিছুই অসত্য, তা অনৈশ্বরিক। জগতে হিন্দু বা মুসলিম বলে কিছু নেই। নেই সাদা কিংবা কালো, রাজা কিংবা ফকির, নারী কিংবা পুরুষের পার্থক্য। কেবল আছেন এক ঈশ্বর। এজন্য বলা হয় ‘ইক ওয়াঙ্কার’ বা সৃষ্টি কর্তা এক। তার সামনে সকল মানবজাতি সমান। নানক বিশ্বাস করতেন, জগতের সকল অনিষ্টের পেছনে মানুষের অহম সম্পৃক্ত। দল এবং উপদল জনিত প্রতিযোগিতাকে দেখেছেন অনর্থক হিসেবে। তার মতে,
যোগীর পরনের ছেড়া তালি দেয়া কাপড়ে ধর্ম নেই,
সে যা বহন করে, তাতেও নেই
শরীরের ভস্মেও নেই;
কানের আংটিতেও থাকে না ধর্ম,
কামানো মাথাতেও না,
শাঁখের খোসায় ফুঁ দেয়াতেও না।
যদি সত্যিই ধর্মের পথ দেখতে চাও;
পৃথিবীর সকল অবিশুদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকো।
পরিণতি
নানক বরাবরই গুরুর আবশ্যকতা নিয়ে কথা বলতেন। পরবর্তীতে ধর্ম এগিয়ে গিয়েছে সেই গুরুদের হাত ধরে। লেহনা (১৫০৪-৫২) ছিলেন অনুরক্ত হিন্দু। নানকের সংস্পর্কে এসে হয়ে উঠলেন গুরু অঙ্গদ। তার নম্রতার দরুণ বিভাজন রোধ হয়ে শিষ্যের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তিনিই বর্ণমালা বাছাই করে নানকের স্তুতিগুলো গ্রন্থিত করা শুরু করেন; যা গুরুমুখী নামে পরিচিত। দুই ছেলে থাকার পরও পরবর্তী গুরু হিসেবে মনোনীত করে যান তেয়াত্তর বছর বয়সী শিষ্য অমর দাসকে (১৪৭৯-১৫৭৮)। শিখদের জন্য বার্ষিক উৎসব, এক বিয়ের প্রচলন, বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রচেষ্টার মতো যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নেন অমর দাস।
পঞ্চম গুরু অর্জুনের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ধর্মীয় সম্প্রীতির চিহ্ন হিসেবে লাহোরের সুফি মিয়া মীরকে দিয়ে তিনি হরমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ববর্তী লেখা সংকলিত করে স্থাপন করেন অমৃতসরে। মোগল সম্রাট আকবর পছন্দ করলেও জাহাঙ্গীরের কোপদৃষ্টি পড়ে তার উপর। কিন্তু প্রথমদিকে তেমন কিছু করেননি। পরবর্তীতে বিদ্রোহী শাহজাদা খসরুকে সমর্থন দেবার অভিযোগে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। অর্জুনের রক্ত শিখ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি পাঞ্জাব জাতীয়তাবাদের বীজে পরিণত হয়। আধ্যাত্মিকতার সাথে যুক্ত হয় অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা। স্থানীয় মুঘল প্রশাসকের স্বেচ্ছাচার থেকে নিপীড়িত হিন্দু ও মুসলমানদের রক্ষা করার তদবির চলে। পরিণামে ১৬৭৫ সালে নবম গুরু ত্যাগ বাহাদুরকে মৃত্যুদণ্ড দেন আরেক সম্রাট আওরঙ্গজেব। বলা প্রাসঙ্গিক, ধর্মের ইতিহাসে ত্যাগ বাহাদুরই একমাত্র প্রচারক, যে ভিন্নধর্মের অধিকার আদায়ে শহিদ।
|
ত্যাগ বাহাদুরের ত্যাগ শিখধর্মকে নতুন করে জেগে উঠার শক্তি দিয়েছে; Image Source: Dailysikhupdates.com |
পিতার মৃত্যুর পর তার ইচ্ছা অনুসারেই মাত্র নয় বছর বয়সে গুরুর আসনে বসেন গোবিন্দ সিং (১৬৬৬-১৭০৮)। বয়সে কম হলেও তার নেয়া পদক্ষেপগুলোই শিখ বিশ্বাসকে মহিরুহে পরিণত করে। তিনি একাধারে শিখেন সংস্কৃত, হিন্দি, পাঞ্জাবি এবং ফারসি; অন্যদিকে রপ্ত করেন ঘোড়ায় চড়া এবং বন্দুক চালনা। পড়াশোনা করেন নানকের বোধিপ্রাপ্তি থেকে তার পিতার মৃত্যুদণ্ড অব্দি শিখদের সংগ্রাম নিয়ে। দাদা হরগোবিন্দের মতো হাতে তুলে নেন তলোয়ার। পরিবর্তন আসলো শিখ সম্প্রদায়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্যেও। শাসকের নিপীড়ন থেকে অসহায় এবং সাধারণকে রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন বিশেষ বাহিনী খালসা। চলতে থাকে সশস্ত্র সংগ্রাম। ততদিনে সকল গুরুর আপ্তবাক্য নিয়ে সুসংগঠিত করা হয়েছে গ্রন্থ সাহিব। গুরু গোবিন্দ মানুষ গুরু পর্বের সমাপ্তি টেনে পরবর্তী গুরু হিসাবে গ্রন্থ সাহিবকে নিযুক্ত করলেন।
গ্রন্থসাহিব
বিশ্বের ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে গ্রন্থসাহিব অনেক দিক দিয়েই আলাদা। কোনো ধর্মীয় প্রধান পুরুষের মতোই এই গ্রন্থ শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে শিখদের অমর গুরুর ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া গ্রন্থসাহিবই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ; যার ভেতরে অন্য ধর্মের মানুষের লেখাও স্থান পেয়েছে। শিখরা মূর্তিপুজা করে না; কিন্তু গ্রন্থটিকে জীবিত গুরুর ন্যায় শ্রদ্ধা করে। মানুষের আত্মিক আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখাগুলি মূলত কবিতার আদলে। লেখাগুলো কেবল পাঠ করা হয় না; কীর্তন হিসাবে সমাবেত কন্ঠে গাওয়া হয়। গ্রন্থসাহিবের থাকার স্থান হিসাবেই শিখ উপসনালয়ের নাম গুরুদুয়ারা বা গুরুর দরজা।
পঞ্চম গুরু অর্জুন বিকৃতির হাত থেকে সত্যবাণী সুরক্ষার জন্য হাত দিয়েছিলেন লেখা সংকলনের। সেই লক্ষ্যে ভাই পিয়ারা, ভাই গুরুদাস এবং বাবা বুদ্ধেকে প্রেরণ করেছিলেন বিভিন্ন প্রান্তে পাণ্ডুলিপি অন্বেষণে। নিজেও ছোটাছুটি করেন পুরাতন গুরুদের পরিবারে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে ১৬০৬ সালে অমৃতসরের হরমন্দিরে স্থাপন করা হয় গ্রন্থসাহিবকে। গুরু অর্জুন নিজেই তার সামনে অবনত শিরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। প্রথম থেকেই লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণভেদে সকলেই এটি পড়তে পারতো। পরবর্তীতে নানা টানাপোড়েন পার হয়ে গুরু গোবিন্দ ১৭০৫ সালে এর সংকলন সমাপ্তি করেন। তখন তার নিজের বয়সও শেষের দিকে। তাই অন্য এক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। নতুন কাউকে গুরু নিযুক্ত না করে গ্রন্থসাহিবকেই পরবর্তী চিরন্তন গুরু বলে নিযুক্ত করলেন ১৭০৮ সালে।
|
গ্রন্থসাহিব কেবল ধর্মগ্রন্থ না, চিরন্তন গুরু; Image Source: khalsaforce.in |
গ্রন্থসাহিবের বিবরণ ধারাবাহিক। গুরুদের স্তোত্রের পরে আছে ভগত বা সাধুদের লেখা। যেখানে গুরু নানকের ৯৭৪টি স্তোত্র, অঙ্গদের ৬২ শ্লোক, অমর দাসের ৯০৭ স্তোত্র, রাম দাসের ৬৭৯ স্তোত্র, অর্জুনের ২২১৮ স্তোত্র, ত্যাগ বাহাদুরের ৫৯ স্তোত্র এবং গুরু গোবিন্দের ১টি শ্লোক। ভগত বা সাধুরা ছিল নানা বিশ্বাসের। তাদের মধ্যে শেখ ফরিদ এবং শেখ ভিখান ছিলেন মুসলমান, কবির ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম নিয়ে মুসলিম ঘরে বেড়ে উঠা, জয়দেব বিখ্যাত সংস্কৃত কবি, রামানন্দ, পরমানন্দ, রবিদাসসহ অনেকেই হিন্দু সাধু। সম্মিলনের এই বৈচিত্র্য গ্রন্থকে অন্য অনেক গ্রন্থ থেকে আলাদা করেছে।
সংস্কৃতি
১৬৯৯ সালের প্রথম প্রহরে উৎসবে যোগদানের জন্য অনুসারীদের জন্য বিশেষ বার্তা পাঠান গুরু গোবিন্দ সিং। নিষেধ করেন চুল ও দাড়ি কাটার জন্য। নির্ধারিত দিনে প্রচুর মানুষের সমাগম হলো। গুরু খাপ থেকে তরবারি বের করে পাঁচজন ব্যক্তির জীবন চাইলেন। কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্থ থাকার পর রাজি হলো এক ব্যক্তি। তাকে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন গুরু। বের হলেন রক্ত মাখা তরবারি হাতে। এভাবে পঞ্চম শিকার নিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে বের হবার সময় পাঁচজনকেই সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে খ্যাত করেন পাঞ্জপিয়ারে বা পছন্দের পাঁচ ব্যক্তি নামে। পরবর্তীতে তারাই পরিণত হন শিখ সম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্র; খালসা বা বিশুদ্ধ নামে।
খালসার দীক্ষা পুনর্জন্মকেই চিহ্নিত করে। গুরু গোবিন্দ পরিষ্কার পানিতে কিছুটা চিনি দিলেন। মেশালেন দুই প্রান্ত বিশিষ্ট খঞ্জরের সাহায্যে। দীক্ষিত করলেন মন্ত্রের মাধ্যমে। পুরুষদের নাম পরিবর্তন করে তার শেষ সিং পদবি লাগিয়ে দেয়া হলো। পরবর্তীতে নারীদের দেয়া হতো কৌর উপাধি। দীক্ষার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী পেশা (ক্রীতনাশ), সম্পর্ক (কুলনাশ), প্রাথমিক ধর্ম (ধর্মনাশ) এবং শিখ পরিপন্থী আচার (কর্মনাশ) ছেড়ে দিতে হয়।
|
খালসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গুরু গোবিন্দ সিং শিখদের নতুন পরিচয় ও রূপ প্রদান করেন; Image Source: sikhcouncil.co.uk |
খালসাদের জন্য পাঁচটা প্রতীক চিহ্নিত হয়। কেশ, কঙ্ঘ, কাচ, কড়া এবং কিরপান। কেশ বা চুল-দাড়ি কাটা যাবে না। পরিপাটি রাখার জন্য চুলে একটা কঙ্ঘ বা চিরুনি বহন করতে হবে। সেই সময়ের যোদ্ধাদের মতো হাঁটু অব্দি লম্বা প্যান্ট বা কাচ পরতে হবে। ডান কব্জিতে একটা লোহার ব্রেসলেট বা কড়া ধারণ করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সর্বদা একটা তলোয়ার বা কিরপান বহন করতে হবে। এই পাঁচটা প্রতীকের বাইরেও আরো চারটি নিয়ম বা রাহাত আছে। কখনোই চুল কাটা যাবে না (আগের আইনের পরিসর বৃদ্ধি), মদ্যপান করা যাবে না, শুধু ঝটকা মাংস বা যেখানে এক কোপে প্রাণী বধ করা হয়, তা খেতে হবে এবং কোন মুসলমান ব্যক্তিকে নিপীড়ন করা যাবে না। বর্তমানে বহুল পরিচিত শিখ পাগড়ির জন্ম আসলে ধর্মীয় মৌলিক আদেশ থেকে না; চুলের সুরক্ষার জন্য পরবর্তীতে উদ্ভাবিত। যাহোক, গুরু গোবিন্দ পাঁচ জনকে দীক্ষিত করে বলে দিলেন ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের দীক্ষা দিতে। এভাবে ছড়িয়ে পড়লো শপথ।
ওয়াহে গুরু জি কা খালসা
ওয়াহে গুরু জি কা ফাতেহ;
অর্থাৎ খালসারা ঈশ্বরের পছন্দের; আমাদের ঈশ্বরের জয় হোক।
তারপর
ভারতে শিখ ধর্মের অনুসারী প্রায় বিশ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ২% এর মতো। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী শিখ নাগরিকের ৮০ শতাংশ কেবল পাঞ্জাবেই থাকে। সেই সময়ে পাঞ্জাবের নাগরিকদের ৬৩ শতাংশ ছিল শিখ। ২০০১ সালের হিসাবে অনুসারে যুক্তরাজ্যে ৩৩৬০০০ মানুষ শিখ ধর্মের অনুসারী; যা মোট জনসংখ্যার ০.০৬%। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান বেশ পোক্ত। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রায়ই শিখদের মুসলিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ইসলামবিদ্বেষের বলির পাঠা হচ্ছে শিখরা; তার কারণ শিখ সম্পর্কে নিয়ে ধারণার কমতি।
|
ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক গুরুদুয়ারা নানকশাহী; Image Source: worldgurudwaras |
হিন্দুধর্ম ও ইসলামের দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের মিলনবিন্দুতে জন্ম নিয়েছে শিখধর্ম। স্রষ্টার সামনে মানুষকে হাজির করেছে নতুন শক্তি দিয়ে। ষোড়শ শতকের দিকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং লিঙ্গের সমতা নিয়ে কথা বলা কম আশ্চর্যের না। শুরুতে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যাত্রা হলেও পরপর গুরুদের হত্যাকাণ্ড তাদেরকে সামরিক কৌশলী করে তোলে। মুঘল যুগের সমাপ্তির দিকে পাঞ্জাবকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় শিখ রাজ্য। খালিস্তান আন্দোলনের কথা কে না জানে! বর্তমান ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই শিখ। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ঠিক পশ্চিম পাশে অবস্থিত শিখধর্মাবলম্বীদের গুরুদুয়ারা। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার এখানে সকল ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের অভ্যাগতরা আহার করতে পারেন।
This Bengali article is about Sikhism, an Indian religion based on human rights and social harmony. Here is the brief introduction of their foundation, belief and evolution over centuries.
References:
1) Sikhism: A Very Short Introduction, Eleanor Nesbitt, Oxford University Press, 2005
2) World Religions: Sikhism, Nikky-Guninder Kaur Singh, Chelsea House Publishers, New York, Third Edition, 2009
3) A History of the Sikhs, Vol-1, Khushwant Singh, Oxford University Press, 2019
Featured Image: sikhnet.com
Article Sourse: roar.meida
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন