Breaking

শনিবার, ৬ জুন, ২০১৫

হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন

বিশ্ববিখ্যাত হলিউড সিনেমার খ্যাতনামা শিল্পীদের একজন চার্লি চ্যাপলিন। প্রতিটি ছবিতে এক একটি “থিম” পরিবেশন করে তিনি পেয়েছেন বিশ্বখ্যাতি। তার ছবি দেখে আনন্দ পাবেনা, এমনটি কোনদিনই হয়নি, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে না।

চ্যাপলিনকেই চলচ্চিত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মুকাভিনেতা ওকৌতুকা ভিনেতাদের একজন মনে করা হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সঙ্গীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। তবে বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রকারের জীবন মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। লল্ডনের ইস্ট লেনের এক দরিদ্র শিল্পী পরিবারে

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল জন্ম হয়েছিল চার্লির। বাবা অভিনয় করতেন থিয়েটারে আর মা ছিলেন গায়িকা। কিন্তু চার্লির এক বছর বয়সে তার মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। মা তখন দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এলেন আলো বাতাসহীন এক বস্তির অন্ধকারে। থিয়েটারে গান করে মা যা পেতেন তা দিয়ে তিনজনের সংসার চলে যেত কায়ক্লেশে । একটু বড় হয়ে চার্লি মাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তিনি সিডনি বাচ্চাদের মধ্যে মজার মজার খেলা দেখিয়ে রোজগার করতে লাগলেন। তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন একদিন গান গাইতে গিয়ে মায়ের কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো মায়ের গান গাওয়া। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটতে লাগলো তাদের। বড় ভাই ‘সিডনি ’ জাহাজে চাকরি নিয়ে দূরদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে ক্ষুধার জ্বালায় যখন যে কাজ পেতেন সে কাজই করতে হয়েছে চার্লিকে। খবরের কাগজ ফেরি করে বিক্রি করা কিংবা জুতা পালিশের কাজ করতেও দ্বিধা হয়নি তার। সুঁড়িখানার সামনে মাতালদের গান শুনিয়ে, নাচ দেখিয়ে টুপি পেতে ভিক্ষেও করেছেন তিনি। এমনি করে চরম দুঃখ-দুদর্শার মধ্যে ১২ বছরে পা দিলেন চ্যাপলিন। দুঃখের জ্বালা সইতে না পেরে মায়ের মাথায় দেখা দিয়েছে গোলমাল।

অগত্যা মাকে পাঠালেন পাগলা গারদে। পাগলা গারদে কিছুদিন থাকার পর মা ভালো হয়ে উঠলেন। এ সময় সিডনিতে একটি চাকরি জুটল

চার্লির। যৎসামান্য মাইনে। তাদের বস্তির বাসায় যাতায়াতের পথেই নাটক দলের অফিসগুলো চোখে পড়ত তার। যদি কোন নাটক দলের সামান্য একটা কাজ পাওয়া যায়। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন। কিন্তু নাটকের অফিসের ভেতরে ঢোকার সাহস হয়ে উঠল না। একদিন মনে সাহস নিয়ে ঢুকে গেলেন এক নাটক দলের অফিসে। তবে কাজের কথা বলতেই কেরানি ভদ্রলোক বের করে দিলেন তাকে। সেদিনের মতো নিরাশ হলেও হাল ছাড়লেন না চার্লি। কিছুদিন পর পর আবার হাজির হন সেই অফিসে। ভাগ্যক্রমে একদিন পড়ে গেলেনমালিকের চোখে। চার্লিকে দেখে তার ভালো লেগে গেলো। ফলে কাজও জুটে গেলো।

সে সময় শার্লক হোমস নামে দলের একটি নাটকে বিলি নামে একটি ছেলে অভিনয় করতো। সে চলে যাবে বলে তার জায়গায় নেয়া হলো চ্যাপলিনকে। মাইনে সপ্তাহে ২ পাউন্ড ১০ শিলিং। কিছুদিনের মধ্যে বড় ভাই সিডনিকেও নাটকের দলে ভিড়িয়ে নিলেন চার্লি। ১৭ বছর বয়সে চার্লির অভিনয়ে মুগ্ধ হলেন ফ্রেডকারনো নামে এক থিয়েটার মালিক। ফুটবল ম্যাচ নাটকে হাসির অভিনয় করার জন্য চার্লিকে তার দলে নিয়ে এলেন তিনি। প্রথম অভিনয়েই মাতিয়ে দিলেন। দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। অপ্রত্যাশিতভাবেই তার জীবনে পরিবর্তনের সুযোগ এলো। কারোনার দলের মালিক ফ্রেডকারনো যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার প্রস্তাব দিতেই লুফে নেন তিনি। নিউইয়র্কের কলোনিয়াল থিয়েটারে প্রথম অভিনয় করলেন। নাটকের নাম অউ-হাউস। পত্র পত্রিকাতে তার অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হলো.। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন চার্লি। একদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন এক সিনেমা কোম্পানির কর্মকর্তা অ্যাডাম কেসেল।


চার্লির অভিনয় দেখে এমন মুগ্ধ হলেন যে নাটক শেষে নিজে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করলেন। প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় অভিনয় করার। চার্লি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন তার প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্রে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেবারের মতো চার্লিকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে হলো। আবার ফিরে এলেন দু’বছর পর। প্রথমেই দেখা করলেন কেসেলের সঙ্গে। জানালেন থিয়েটারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই সিনেমা কোম্পানিতে যোগ দেবেন। সিনেমায় চার্লির মাইনে সপ্তাহে ২৫ ডলার। কিন্তু তার মন দমে গেল। কারণ সেই সময় সিনেমার নির্বাক যুগ। অভিনেতাদের মুখে সংলাপ নেই। পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য অভিনয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাজনা বাজানো হয়। নিতান্ত দায়সারাভাবে একটা ছবিতে অভিনয় করলেন তিনি। কোম্পানির মালিক ম্যাক সেনেট তো রীতিমতো নিরাশ। চার্লি সরাসরি তার অভিযোগগুলো প্রকাশ করলেন। অভিনয়ে তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সাজ-পোশাকও পরতে হয়েছে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।


শিল্পীর স্বাধীনতা মেনে নিলেন ম্যাক সেনেট। দ্বিতীয় ছবিতে অভিনয় করতে হবে সাংবাদিকের ভূমিকায়। সম্পূর্ণ হাসির রোল। চিন্তায় পড়ে গেলেন চার্লি। চার্লি যে ঘরে থাকেতেন তার পাশের ঘরেই থাকতেন দশাসই চেহারার এক অভিনেতা। হঠাৎ চার্লির মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো। তার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দৈহিক মাপের সেই অভিনেতার ঢোলাঢালা ট্রাউজারটা পরে নিলেন তিনি। গায়ে চাপলেন নিজেরই ছোট হয়ে যাওয়া একটা জ্যাকেট। মাথায় পরলেন বউলার টুপি। লম্বা টাই ঝোলালেন গলায়। প্রতিবেশী অভিনেতার বিরাটআকারের জুতো দিয়ে পা ঢাকলেন।তবে উল্টোভাবে। হাতে নিলেনছোট ছড়ি। ঠোঁটের ওপরে সাঁটলেনবাটারফ্লাই গোঁফ।সেদিন হয়ত কল্পনাও করতে পারেননি যে এই বিচিত্র উদ্ভট সাজেই একদিনজগৎ জোড়া খ্যাতির অধিকারী বেন তিনি। এরই মধ্যে একে একে মুক্তিপেতে লাগল চার্লির দুনিয়া কাঁপানো সব ছবি। দ্য কিড, দ্য পিলগ্রিম, অ্যা উম্যান অব প্যারিস, দ্য গোল্ডরাশ, দ্য সার্কাস, দ্য সিটি লাইট ইত্যাদি।


১৯৩১ সালে হলিউডে নির্বাক ছবির যুগ শেষ হলে হিটলারকে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নির্মিত হলো চার্লির ‘দ্য গ্রেট ডিকটেটর’। এ ছবিতে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর কৌতুকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন হিটলারের চরিত্র। ১৯১৪ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত নির্মিত য়েছে চার্লির জীবনের শ্রেষ্ঠতম সব ছবি। মঁসিয়ে ভার্দু, লাইম লাইট, অ্যা কিং অব নিউইয়র্ক, সিটি লাইট, দা গ্রেট ডিক্টেটর, গোল্ড রাশ, দা কিড, দা সারকাস, দা ইমিগ্রান্ট, দা ডগস লাইফ এর মধ্যে অন্যতম ছবি। অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনও প্রেমে পড়েছিলেন । একবার নয়, একাধিকবার। চার্লি চ্যাপলিন সর্বপ্রথম প্রেমে পড়েছিলেন হেটি নামের এক অপূর্ব সুন্দরীর । মেয়েটির বাড়ি ছিল লন্ডনেই । ১৯০৮ সালে, ১৯ বছর বয়সী চার্লি দক্ষিণ লন্ডনের এক থিয়েটারেঅভিনয় করছিলেন । একই হলে অভিনয় করতে আসত হেটি । প্রথম দর্শনেই যেকোনো যুবকের মন কেড়ে নেওয়ার মতো রূপ তার । মন কাড়ল চার্লি চ্যাপলিনের । প্রথম দিনের ঘটনা । একসময় মেয়েটির নাচ শেষ হয়ে যায় । মঞ্চের পর্দা নেমে আসে । কিন্তু চার্লির কোনো পরিবর্তন নেই । সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার । অবাক চোখে তখনো তিনি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চলভাবে । হঠাৎ একজনের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো । অত্যন্ত ব্যাকুল অস্থিরতায় ভুগছিলেন তিনি । মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবেন। আস্তে আস্তে মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন । বুকটা দুরু দুরু করছে । কি করবেন ? প্রথম কি কথা বলবেন, তিনি মেয়েটাকে । সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটিকে বললেন, খুব সুন্দর নেচেছো তুমি । কি নাম তোমার ? সে উত্তর দিল : হেটি । বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল চার্লি চ্যাপলিনের । অনেক কথা হলো উভয়ের মধ্যে । কথা থেকে প্রণয় । প্রথম দিনের প্রথম দেখাতেই দু’জন প্রেমে পড়ে গেলেন । হেটি আর চ্যাপলিন । দেখতে দেখতেই তাদের অন্তরঙ্গতা এত ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল যে, কেউ কাউকে একদিন না দেখে থাকতে পারেন না ।

এক মুহূর্ত দূরে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয় । অভিনয়ের কাজে চ্যাপলিনকে দূরে যেতে হয় । কিন্তু সেখানে তার একটুও ভালো লাগে না । অভিনয়ের ফাঁকে সামান্য অবসর পেলেই তিনি ছুটে যেতেন প্রিয়তমা হেটির কাছে । এমনিভাবে দুটি বছর কাটার পর হঠাৎ একদিন চার্লি চ্যাপলিনকে চলে যেতে হয় আমেরিকায় অভিনয়ের কারণে । প্রিয়তম চার্লিকে বিদায় জানাতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসাল হেটি । নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল চার্লি চ্যাপলিন । ওখানে গিয়ে নিয়মিত খবর রাখতেন তিনি হেটির । অবশেষে একদিন দেশে ফিরে এলেন চার্লি । কিন্তু তার সে আশা আর পূর্ণ হলো না । শুনলেন হেটির বিয়ে হয়ে গেছে । তাও আবার হেটির নিজের ইচ্ছাতে। ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বরে চার্লি প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান সুইজারল্যান্ডের কার্সিয়ারে । ওই দেশের ডিঙ্গিতে চার্লির শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু এর পর ঘটে একটা দুর্ঘটনা । পরের বছর চার্লির মৃতদেহ চুরি হয়ে যায় । ১৬ দিন পরে তা উদ্ধার করে আবার সমাহিত করা হয় । তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও চার্লি এখনো গোটা বিশ্বে সমানে জনপ্রিয় । সবাই তাঁকে কৌতুক সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন । চ্যাপলিনকে নিয়ে চমৎকার একটা গান গেয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় । যুক্তরাজ্যের জাতীয় আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত নথিতে জানানো হয়, চার্লি চ্যাপলিনের আসল নাম হলো ইসরায়েল থর্নস্টেইন। চ্যাপলিন তাঁর ছদ্মনাম ।(তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা চ্যাপলিনের ছদ্মনাম নিয়ে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি ।) আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, এমআইফাইভের এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এমন হতে পারে যে চ্যাপলিনের জন্ম রাশিয়ায় । তিনি একবার রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন । আবার এমনোও হতে পারে যে চ্যাপলিন ইহুদি বংশোদ্ভূত । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিকের মতো । যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি বই লিখলেন, সিনেমা করলেন, বক্তৃতাও দিলেন । সেই সময় তার সখ্যতা বাড়লো কমিউনিষ্টদের সাথে । তখন তিনি করেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘মানুষকে ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে কমিউনিষ্ট বলা হয়, তো আমি কমিউনিষ্ট’ ।

চার্লির ছবির বিশেষত্ব হলো মানুষের জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, সুখ, ব্যথা- বেদনা ও অনুভূতির ব্যঙ্গময় প্রকাশ। যা তাকে দিয়েছে কালোত্তীর্ণ বিশ্বখ্যাতি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চার্লি। মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ, শ্লেষ ও মানবিক চেতনা তার প্রতিটি ছবির মূল প্রতিপাদ্য ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন