Breaking

রবিবার, ৭ জুন, ২০১৫

হিটলার কে নিয়ে কিছু কথা

পৃথিবীর ইতিহাসে তার চেয়ে ঘৃনিত কোন ব্যাক্তির জন্ম হয়নি কখনো। নৃশংসতায় তার কাছে হার মেনেছিলো স্বয়ং চেঙ্গিস খানও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার নির্মমতায় রক্তে ভেসে গিয়েছিলো পৃথিবীর অর্ধেক জনপদ। হত্যা করেছিলেন পৃথিবীর প্রায় সব ইহুদীকে। তার খুনের বর্ণনা পড়লে এখনো ভয়ে বুক কেঁপে উঠে অনেক মানুষের। এমন কি নিজের দেশ জার্মানীতেও সে সভ্যতার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যাক্তি। বলছি এডলফ হিটলারের কথা! এমটিনিউজ২৪ডটকম-এর পাঠকদের জন্যে আজ থাকছে হিটলারের জীবনী-
হিটলারের শৈশব
হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়া ব্রনাউ নামের ছোট্ট একটি শহরে। হিটলার ছিলেন তার বাবার তৃতীয় স্ত্রীর তৃতীয় সন্তান। হিটলারের বাবা Alois এর আসল বাবা কে তা কখনোই জানা যাইনি। তাই বৈধভাবে Alois এর কোন সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। তিনি জীবনের অনেকটা সময় শেষ নাম হিসেবে মায়ের নাম Schicklgruber ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৭৬ সালেই Alois প্রথম হিটলার নামটি গ্রহণ করেন। তার ছেলে অ্যাডলফও কখনও হিটলার ছাড়া অন্য কোন শেষ নাম ব্যবহার করেনি। হিটলারের বাবা সরকারী কাস্টমসে সামান্য চাকরি করত। যা আয় করত তা দিয়ে তিন বউ আর তাদের ছেলেমেয়েদের দুই বেলার খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতো সে।
সপরিবারে অস্ট্রিয়ায়
সরকারী কাস্টম্‌স থেকে অবসর গ্রহণের পর হিটলারের বাবা সপরিবারে অস্ট্রিয়ার লিন্‌ৎস শহরে চলে আসেন। এখানেই হিটলারের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। এ কারণে সারাজীবন তিনি লিন্‌ৎসকে ভালবেসে গেছেন। কোন শহরকে এর উপরে স্থান দিতে পারেননি। বাবাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন না বরং ভয় করতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কোন কমতি ছিল না তার।
হিটলার হতে চেয়েছিলেন চিত্রশিল্পী
হিটলারের বাবা ১৯০৩ সালে মারা যান। বাবার রেখে যাওয়া পেনশন ও সঞ্চয়ের অর্থ দিয়েই তাদের সংসার কোনমতে চলতে থাকে। অনেক ভোগান্তির পর ১৯০৭ সালে তার মাও মারা যান ফলে হিটলার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। পড়াশোনায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এক সময় ভিয়েনায় যান। কিন্তু চিত্রশিল্পী হবার স্বপ্ন নিয়ে আবার লিন্‌ৎসে ফিরে আসেন। শিল্পী হিসেবেই তার বেশ সম্ভাবনা ছিল। এই উদ্দেশ্যে অস্ট্রিয়ার "একাডেমি অফ ফাইন আর্টস"-এ ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু সুযোগ পাননি। তাই হিটলার আবার ভিয়েনায় চলে যান।
ভিয়েনাতে মজুরের কাজ
ভিয়েনাতে এসে তিনি প্রথমে মজুরের কাজ করতেন। কখনো মাল বইতেন। এরপর রং বিক্রি করতে আরম্ভ করলেন। ভিয়েনাতে থাকার সময়েই তার মনের মধ্যে প্রথম জেগে ওঠে ইহুদি বিদ্বেষ। তখন জার্মানির অধিকাংশ কলকারখানা, সংবাদপত্রের মালিক ছিল ইহুদিরা। দেশের অর্থনীতির বেশি ভাগ অংশই তারা নিয়ন্ত্রণ করত। হিটলার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না, জার্মান দেশে বসে ইহুদিরা জার্মানদের উপরে প্রভুত্ব করবে।
সৈনিক জীবন শুরু
১৯১২ সালে তিনি ভিয়েনা ছেড়ে এলেন মিউনিখে। সেই দুঃখ-কষ্ট আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে আরো দুই বছর কেটে গেল। ১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এই যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিলেও কোনো পদোন্নতি হয়নি। যুদ্ধ শেষ হয়ার পর দেশজুড়ে হাহাকার আর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিভিন্ন বিপ্লবী দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এসময় এদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য হিটলারকে নিয়োগ করলেন কর্তৃপক্ষ।
হিটলারের নাৎসি পার্টি
হিটলারকে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য নিয়োগ করা হয় তখন প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল লেবার পার্টি। হিটলার সেই পার্টির সদস্য হন। অল্পদিনেই পাকাপাকিভাবে পার্টিতে নিজের স্থান করে নেন হিটলার। এক বছরের মধ্যেই তিনি পার্টির প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। নেতা হয়েই তিনি দলের নতুন নাম রাখেন ‘ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি’। পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হতো ‘নাৎসি পার্টি’। ১৯২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম নাৎসি দলের সভা ডাকা হলো। এতেই হিটলার প্রকাশ করলেন তার পঁচিশ দফা দাবি। এরপর হিটলার প্রকাশ করলেন স্বস্তিকা চিহ্নযুক্ত দলের পতাকা। ক্রমশই নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিন বছরের মধ্যেই দলের সদস্য হলো প্রায় ৫৬০০০ এবং এটি জার্মান রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করল।
হিটলারের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ
হিটলার চেয়েছিলেন মিউনিখে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এই সময় তার পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাকে এক বছরের জন্য ল্যান্ডসবার্গের পুরনো দুর্গে বন্দি করে রাখা হলো। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কাজে আবার ঝাপিয়ে পড়েন হিটলার। তার উগ্র স্পষ্ট মতবাদ, বলিষ্ঠ বক্তব্য জার্মানদের আকৃষ্ট করল। দলে দলে যুবক তার দলের সদস্য হতে আরম্ভ করল। সমস্ত দেশে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন হিটলার।
জার্মানির ভাগ্যবিধাতা হিটলার
হিটলার ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোট পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন। পার্লামেন্টের ৬৪৭টির মধ্যে তার দলের আসন ছিল ২৮৮টি। বুঝতে পারলেন ক্ষমতা অর্জন করতে গেলে অন্য পথ ধরে অগ্রসর হতে হবে। তাই কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় হিটলার পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন। এবার ক্ষমতা দখলের জন্য শুরু হলো তার ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্ত। বিরোধীদের অনেকেই খুন হলেন। অনেকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে গেল। বিরোধী দলের মধ্যে নিজের দলের লোক প্রবেশ করিয়ে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিরোধী পক্ষকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে হিটলার হয়ে উঠলেন শুধু নাৎসি দলের নয়, সমস্ত জার্মানির ভাগ্যবিধাতা।

হিটলারের নতুন আইন – ‘জেন্টিল ও জু’
হিটলার জার্মানির ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার প্রচার। তিনিই জার্মানদের মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষের বীজকে রোপণ করেছিলেন। দেশ থেকে ইহুদি বিতাড়নই ছিল তার নাৎসি বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য। দেশের প্রান্তে প্রান্তে ইহুদি বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শুরু হলো তাদের ওপর লুটতরাজ, হত্যা। হিটলার চেয়েছিলেন এভাবে ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়ন করবেন। কিন্তু কোনো মানুষই সহজে নিজের আশ্রয়স্থল ত্যাগ করতে চায় না। তাই ১৯৩৫ সালে নতুন আইন চালু করলেন হিটলার। তাতে দেশের নাগরিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হলো, জেন্টিল আর জু। জেন্টিল অর্থাৎ জার্মান, তারাই খাঁটি আর্য, জু হলো ইহুদিরা। তারা শুধুমাত্র জার্মান দেশের বসবাসকারী, এদেশের নাগরিক নয়। প্রয়োজনে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। দেশজুড়ে জার্মানদের মধ্যে গড়ে তোলা হলো তীব্র ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাব।
জার্মানির ফুয়েরার হিটলার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ইউরোপের মিত্রপক্ষ ও জার্মানদের মধ্যে যে ভার্সাই চুক্তি হয়েছিল তাতে প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমস্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জার্মানির গৌরব পুনরুদ্ধার করার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং তিনি একে একে ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলো মানতে অস্বীকার করে নিজের শক্তি ক্ষমতা বিস্তারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৪ সালে হিটলার রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকে জার্মানির ফুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে নিজেকে দেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার এই সাফল্যের মূলে ছিল জনগণকে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা। তিনি দেশের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে জনগণের কাছে বলতেন ভয়াবহ বেকারত্বের কথা, দারিদ্র্যের কথা, নানা অভাব-অভিযোগের কথা।
জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি
হিটলার তার সমস্ত ক্ষমতা নিয়োগ করলেন দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। তার সহযোগী হলেন কয়েকজন সুদক্ষ সেনানায়ক এবং প্রচারবিদ। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে রাইনল্যান্ড অধিকার করলেন। অস্ট্রিয়া ও ইতালি ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হলো জার্মানির সাথে। ইতালির সর্বাধিনায়ক ছিলেন মুসোলিনি। একদিকে ইতালির ফ্যাসিবাদী শক্তি অন্যদিকে নাৎসি জার্মানি। বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে ইতালি। প্রথমে আলবেনিয়া ও পরে ইথিওপিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়। এর পরপরি হিটলার পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ ও পোলিশ করিডর দাবি করলেন। যাতে এই অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারেন। পোল্যান্ডের সরকার তার এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। পোল্যান্ডের ধারণা ছিল হিটলার তার দেশ আক্রমণ করলে ইউরোপের অন্য সব শক্তি তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাদের সম্মিলিত শক্তির সামনে জার্মান বাহিনী খুব সহজেই পরাজিত হবে। কিন্তু এটাই ছিল ভুল ধারণা। কারণ সেই সময় তারা হিটলারের সামরিক শক্তি সম্পর্কে যে ধারণা করেছিল তা ছিল একে বারেই ভুল।
হিটলারের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ইউরোপের ভুল ধারণা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি বড় কারণ জার্মানির সামরিক শক্তি সম্বন্ধে ইউরোপের অন্য সব দেশের সঠিক ধারণার অভাব। আর একটি বড় কারণ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রথম পর্যায়ে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হিটলার ও মুসোলিনির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায়নি। তাছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ‘চেম্বারলিন’ এর ধারণা ছিল হিটলারের ক্ষমতা শুধুমাত্র প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া সেই সময় ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে জার্মানির চেয়ে বড় শত্রু ছিল কমিউনিস্ট রাশিয়া। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে জার্মানরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাই যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত শর্ত ভঙ্গ করে জার্মানরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছিল তখন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কেউ তাদের বাধা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। উপরন্তু হিটলারকে নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন